শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন
মোঃহাফিজুল ইসলাম শান্ত: বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা শহরের প্রান কেন্দ্র থেকে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা শ্রীমন্ত নদীর অস্তিত্ব পাওয়া এখন কঠিন।এলাকাবাসী এটিকে মরা খাল বলে ধরে নিয়েছেন। প্রায় বিলীন হওয়া শ্রীমন্তর দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা আর বাসাবাড়ির সুয়ারেজ লাইন মিলে রীতিমতো এটি একটি নালায় পরিণত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে নদীটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। সেইসঙ্গে চলছে দখলের মহোৎসব। নদীটির পাড় দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন চলছে মাঝখানের অংশ দখলের প্রতিযোগিতা।
নদীর মাঝখানে পৌর কর্তৃপক্ষ একাধিক সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। কোন প্রকার অনুমোদন ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে এ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করায় শ্রীমন্ত নদীপথে নৌ-যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের নদনদী সংরক্ষনকারী প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নদীর তালিকায় বাকেরগঞ্জের ‘শ্রীমন্ত নদী’ নামটি রয়েছে। কয়েক বছর আগেই দুপাশের তীর দখল ও দুষনে ‘শ্রীমন্ত’ নদীর ‘শ্রী’ হারিয়েছে। এখন সেটি বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
পৌর শহরের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীর ৩ কিলোমিটারের পুরোটাই দখলদারদের নিয়ন্ত্রনে। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালী সবাই আছেন দখলদারের তালিকায়। শহরের মধ্যে দখলের চিত্রই বলে দেয়- একটি খরস্রোতা নদী কিভাবে হত্যা করা যায়। মাত্র দুই দশক সময়ের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীর এমন মৃত্যু হয়েছে বলে জানিযেছেন স্থানীয়রা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড ব্রীজ সংলগ্ন শ্রীমন্ত নদীতে হকার্স মার্কেট নির্মান করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। ওই মার্কেটের চা দোকানী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জানান, নির্মিত এই হকার্স মার্কেটে ৪১ টি দোকান রয়েছে। ছোট দোকানগুলো থেকে ৮৩ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করে দোকান নিয়েছেন যাহার মাসিক ভাড়া ১৫০০ টাকা।
ওই মার্কেটের আরেকজন চা ব্যবসায়ী সমির জানান, তিনি এই মার্কেটে ২টি দোকান নিয়েছেন ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে। প্রতি মাসে তিনি ওই ২ দোকানে ভাড়া দেন ৮ হাজার টাকা। এভাবেই সব দোকানদার অগ্রিম টাকা দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শহরের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুলাতলী নদী শ্রীমন্ত নদীর উৎস মুখ। শহরে মাঝ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে নদীটি। শ্রীমন্ত নদী প্রায় ২২ কিলোমিটার লম্বা। তুলাতলী নদী থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত অংশটি মাঝ বরাবর এসে দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। মুলধারাটি কানকি নামক স্থানে শেখ হাসিনা সেনানিবাসের পাশ দিয়ে পায়রা নদীতে মিশেছে।
অপর অংশটি বাকেরগঞ্জের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন স্থান বাকেরগঞ্জ বন্দর, কালিগঞ্জ বাজার, নিয়ামতি হয়ে বিষখালী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পৌর শহরের জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা মেটাতো এ শ্রীমন্ত নদী। স্থানীয় বাসিন্দা গৃহবধূ সুমি জানান, শ্রীমন্ত নদীর দুইতীরের বাসিন্দাদের স্যুয়ারেজ সংযোগ দেয়া হয়েছে নদীতে। এতে নদীর পানি ব্যবহার উপযোগীতা হারিয়েছে। বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ম্যাপ অনুযায়ী শ্রীমন্ত নদীর প্রশস্ততা স্থানভেদে সর্বনিম্ন ১৫০ থেকে ৬০০ ফুট পর্যন্ত। দুই যুগ আগেও এই প্রশস্ততা বহাল ছিল।
তখন বাতাসে ঢেউয়ের শব্দ ভেসে আসতো। বাহারী পানসি, লঞ্চ, ট্রলার, নৌকা ছুটতো নদীর বুক চিরে। এ অঞ্চলে বড় বন্দর ও হাট-বাজার নলছিটির মোল্লারহাট, মীর্জাগঞ্জের সুবিদখালী, চান্দুখালী এবং বেতাগী ও পাথরঘাটা উপজেলার পণ্যবাহী নৌযানের প্রধান রুট ছিল শ্রীমন্ত নদী। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। দখলের কবলে পড়ে শ্রীমন্ত নদীর উত্তাল ঢেউ আর স্রোত হারিয়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে।
এখন আর নদী আগের অবস্থায় উদ্ধার নয়, দখলদারের কবল থেকে বর্তমান খালটি বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বাকেরগঞ্জবাসী। অনুসন্ধানে জানা যায়, পৌর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর দুইপাশে ১, ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জনপদ। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তুলাতলী নদীর উৎস্য মুখ থেকেই দখল শুরু। এরপরে সামনের দিকে যতই অগ্রসর হয়েছে দখলে সরু হয়ে মৃত খালে পরিনত হয়েছে শ্রীমন্ত নদী। পৌর শহরে ৩ কিলোমিটার শ্রীমন্ত নদীর পুরোটার একই চিত্র।
বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের বাকেরগঞ্জ বাসষ্টান্ডে সেতুর ওপর দাড়িয়ে দেখা গেছে, নদীর দুইতীর ভরাট করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য পাকা-আধাপাকা ভবন। সেতুর পশ্চিমে আল আমিন মসজিদ থেকে শুরু হয়ে পুর্বে থানা ভবন পর্যন্ত ১ কিলেমিটারের মধ্যে সদর রোড আফসার মার্কেট, গাজী মঞ্জিলসহ সব শ্রীমন্ত নদী দখল করে নিমান করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, শ্রীমন্ত নদী দখলে আছে স্থানীয় শীর্ষ জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকেই।
ভাঙ্গন ঠেকানোর অজুহাত তুলে নদীর দুই পাড়ে ব্লক দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনসহ নানা ফন্দিতে নদী দখল করা হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলী আবুল খায়ের গণমাধ্যমকে বলেন, শ্রীমন্ত নদী তাদের আওতাধীন নয়। তারপরেও নদীর পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই মাস আগে ৪ দশমিক ৪৮ মিটার খনন করেছেন। এতে পৌর শহরের অংশে পানির প্রবাহ অনেকটা ফিরে এসেছে। বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ রাকিব হোসেন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন শ্রীমন্ত নদীতে পৌর কর্তৃপক্ষ যে মার্কেট ও সেতু নির্মাণ করেছে, সে বিষয়টি তার জানা নেই।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বাকেরগঞ্জ উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা সজল চন্দ্র শীল জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি জমির উপর পৌর কর্তৃপক্ষের মার্কেট ও সেতু নির্মাণ করার এখতিয়ার নেই। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন ছাড়া অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হলে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তাকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।